এম এ খালেক:
জাতিসংঘ তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যেসব উন্নয়নশীল দেশ ইতোমধ্যে দারিদ্র্যবিমোচনে সাফল্য প্রদর্শন করেছিল, তারা এবার নতুন করে সংকটে পতিত হতে যাচ্ছে।
করোনাভাইরাসজনিত বিপর্যয়কর পরিস্থিতির উন্নতি হলে বিশ্বব্যাপী তাৎক্ষণিকভাবে অন্তত ১০ কোটি মানুষ নতুন করে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসতে পারে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আগামী ২-১ বছরের মধ্যে এদের অনেকেরই দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করার কথা ছিল; কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তারা দারিদ্র্যসীমার উপরে তো উঠতে পারবেই না, বরং নতুন করে সামর্থ্য হারিয়ে স্থায়ীভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসতে পারে।
বিশেষ করে যারা এতদিন নিুমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র রেখার মাঝামাঝি অবস্থান করছিলেন, তারাই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পতিত হবেন। জাতিসংঘের এ মন্তব্য যে মোটেও অতিরঞ্জিত নয়, তা বোধহয় বেশি ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন হয় না। বর্তমানে একটি দেশও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
নিকট অতীতে বিশ্ববাসী অনেকবারই নানা ধরনের ভাইরাস সংক্রমণ প্রত্যক্ষ করেছে; কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো এত ব্যাপক-বিস্তৃত ভাইরাস সংক্রমণ আর প্রত্যক্ষ করেনি। উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে প্রতিটি দেশ এ ভাইরাসের কারণে মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। এ অবস্থা আগামীতে আরও কতদিন চলতে থাকবে, তা কেউই নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না। প্রতিটি দেশই করোনার কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগামীতে এ আর্থিক ক্ষতির অভিঘাত থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যাবে, তা নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিবিদরা চিন্তিত।
বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো কীভাবে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে, তা নিয়ে ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির ক্ষেত্রে করোনার অভিঘাত অত্যন্ত মারাত্মকভাবে আঘাত হেনেছে। জাতিসংঘের রেটিং অনুসারে বাংলাদেশ কিছুদিন আগে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এটাই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন। সবকিছু ঠিক থাকলে, বিশেষ করে আর্থিক ভঙ্গুরতা কাটিয়ে উঠতে পারলে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্বের মাত্র ৫টি দেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছে। কয়েক বছর আগে প্রতিবেশী দেশ নেপাল প্রাথমিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল; কিন্তু মারাত্মক ভূমিকম্পের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না পারার কারণে দেশটি পুনরায় স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে নেমে গেছে। কাজেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এটাই শেষ কথা নয়, আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। কিন্তু হঠাৎ করে সৃষ্ট করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত আর্থিক অভিঘাতের কারণে আগামীতে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির আশা নিরাশায় পরিণত হতে পারে।
সরকারি হিসাবমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশ প্রথমবারের মতো ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল তাতে আশা করা হয়েছিল সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার আরও খানিকটা বাড়বে। কিন্তু করোনা সব সম্ভাবনাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। একটি বেসরকারি সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৩ থেকে ৪ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
চলতি অর্থবছরের জন্য প্রণীত জাতীয় বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সম্ভাব্য হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এটা যে কোনোভাবেই অর্জনযোগ্য নয়, তা সবাই বুঝতে পারছে। যে ১২টি সূচকের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে তার প্রায় সবই নেতিবাচক ধারায় প্রবহমান রয়েছে। আগামীতে খুব সহসাই এসব সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে পণ্য রফতানি আয় মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, মে মাসের রফতানি আয় আগের মাসের তুলনায় ৬৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। একমাত্র জনশক্তি রফতানি খাতের আয় সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে রেকর্ড সৃষ্টি করতে চলেছে। জুনে বাংলাদেশ ১৮৩ কোটি মার্কিন ডলার রেমিটেন্স আয় করেছে।
পুরো বছরের রেমিটেন্স আয় ১ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার অতিক্রম করে যেতে পারে। জনশক্তি রফতানি খাতের এ রেকর্ড পরিমাণ আয় আমাদের উল্লসিত করলেও এতে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে। উল্লেখ্য, করোনার সংক্রমণ এবং অন্যান্য কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য উন্নত বিশ্ব এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো শ্রমিক ছাঁটাই করছে ব্যাপকভাবে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই দেশে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন।
যেহেতু তারা দেশে ফিরে আসছেন এবং আগামীতে প্রবাসী কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, তাই তারা স্থানীয়ভাবে সঞ্চিত তাদের অর্থ একযোগে দেশে নিয়ে এসেছেন। মূলত এ কারণেই সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে এসেছে। সরকারি হিসাবে ২৩ হাজার শ্রমিক দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন।
কিন্তু বেসরকারি হিসাবমতে, ইতোমধ্যে লাখ তিনেক প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। স্থানীয়ভাবে এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। এদের অনেকের পরিবার যারা এতদিন বিত্তবৈভবের মধ্যে বসবাস করছিলেন, তারা হঠাৎ করেই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারেন।
স্থানীয়ভাবে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন এসএমই উদ্যোক্তারা। দেশে মোট ৭০ লাখ এসএমই উদ্যোক্তা আছেন, যাদের বেশিরভাগই কর্মসংকটে পতিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এসএমই সেক্টরের জন্য ইতঃপূর্বে মঞ্জুরিকৃত ব্যাংক ঋণের মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি টাকার কিস্তি বাকি পড়েছে। তারা চেষ্টা করেও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না।
একটি সূত্রমতে, দেশে যেসব প্রোডাকশন ইউনিট আছে তার মধ্যে ৮৭ শতাংশই এসএমই সেক্টরের। শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে এসএমই সেক্টরের অবদান ৩৩ শতাংশ। ১৩ লাখ ৯১ হাজার শ্রমিক এতে যুক্ত রয়েছেন। এদের বেশিরভাগই করোনা সংক্রমণজনিত কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন। দেশে পর্যটন শিল্পে কর্মরতদের অনেকেই ইতোমধ্যে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন।
বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, করোনা সংক্রমণজনিত কারণে বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্পের ৫ কোটি শ্রমিক সরাসরি চাকরি হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। এদের বেশিরভাগই হবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের। একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে কর্মচ্যুত হয়ে রাজধানীর ৬৩ শতাংশ শ্রমিক তাদের বাড়ি ভাড়া দিতে পারেননি।
অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, দেশের ৯৫ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় করোনা সংক্রমণের কারণে হ্রাস পেয়েছে। ৬২ শতাংশ ক্ষুদ্র আয়ের মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়েছে। রাস্তার পাশে যেসব ক্ষুদ্র দোকানি ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অনেকটাই সচ্ছলভাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাদের বেশিরভাগই বর্তমানে বেকার। আগে দেখা যেত কোনো আর্থিক সংকট দেখা দিলে গ্রামের মানুষ শহরে ছুটে আসতেন; কিন্তু এবার তার উল্টো পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকেই বাড়ি ভাড়া দিতে না পেরে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন।
গ্রাম থেকে শহরে চলে আসা মানুষ পুনরায় গ্রামে গিয়ে বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন পাচ্ছেন না। ফলে তারা আবারও পরিস্থিতির উন্নতি হলে শহরে চলে আসবেন। কিন্তু শহরে এসে তাদের হারানো কর্মসংস্থান ফিরে পাওয়ার সুযোগ নেই বলেই মনে হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের বেতন দিতে না পেরে ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছে। একসময় যারা শহরে জীবিকা অর্জন করার মতো অবলম্বন নিয়ে কোনোভাবে টিকে ছিলেন, তারা এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন।
আগামীতে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে এটি নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। জাতীয় পর্যায়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং সাধারণ দরিদ্র মানুষের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা একান্তই প্রয়োজন। যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন, তাদের যদি রক্ষা না করা যায়, তাহলে আগামীতে দেশে সামাজিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে। তাই এখনই এ ব্যাপারে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক।
এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক